বেদ যজ্ঞ সম্মেলনঃ—০৮/ ০৭/ ২০১৬
স্থানঃ—ঘোড়শালা* মুর্শিদাবাদ* পঃ বঃ
আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ—[
বেদ যজ্ঞ করে যত তুমি সকলের হবে তত তোমার ঈশ্বর সবার হবেন।]
আজকের বেদ যজ্ঞ সম্মেলনে বিষয়বস্তু
নিয়ে আলোচনার পূর্বে সকলকে প্রথমেই জানাই আমার অন্তরের প্রণাম- ভালবাসা- প্রীতি-
শুভেচ্ছা ও সালাম। ঈশ্বর মহাসত্যের মধ্যে একাই অবস্থান করছিলেন। তিনি চিন্তা করলেন
বহু হবেন। চিন্তা করার সাথে সাথে সকলকে সৃষ্টি করলেন মহাসত্য থেকে এবং সকল সৃষ্টির
মধ্যেই তিনি পূর্ণ রূপে প্রবিষ্ট হলেন। তাহলে এখানে কারও মনে দ্বিধা- দ্বন্দ্ব
থাকা উচিত নয় যে স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টি এক নয়। সব সৃষ্টির শেষে তিনি নিজের মতো
করেই মানুষকে সৃষ্টি করলেন এবং তাঁর মধ্যেও তিনি পূর্ণ রূপেই রয়ে গেলেন। ঈশ্বর
সবায়কে সৃষ্টি করে সবার হয়ে রইলেন। এই মহাসত্য জানতে গিয়েই মানুষ বিকারগ্রস্থ হয়ে
পড়েন। এই যাবতীয় বিকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তখন চললো মানুষের নিয়ত
ধ্যানপ্রয়াস। এই ধ্যান বা চিন্তার মাধ্যমে সর্বদা বিবেককে অর্থাৎ সদসদ
বিচারবুদ্ধিকে রক্ষা করার জন্য চলতে লাগলো একটা প্রক্রিয়া। মানুষের এই ধ্যানেই
এলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, যম, অগ্নি, বায়ু,ধাতা, মিত্র, অর্যমা, রুদ্র,
বরুণ, সূর্য, ভগ, বিবস্বান, পূষা, সবিতা, ত্বষ্টা, কত দেবতা বেদের মন্ত্র নিয়ে এবং
জেগে উঠলেন তাঁরা বেদে, বেদ যজ্ঞের মাধ্যমে। হাজার হাজার মুনি- ঋষির সৃষ্টি হলো। বেদের মন্ত্রগুলি
হয়ে উঠলো সবার কণ্ঠের আনন্দ মালা। এতো দেব দেবতা এতো মন্ত্র- তন্ত্র তবুও কেউ একে
অপরের থেকে পৃথক নন। সমস্ত দেব- দেবতা- মুনি- ঋষি এক বেদকে ধরে রেখে সবার হয়েই
রইলেন। বহু মন্ত্র- তন্ত্র- স্তব- স্তুতি রচনা করছেন বিভিন্ন দেব-দেবতার জন্য
কিন্তু পরিশেষে এক ব্রহ্ম ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে প্রাধান্য দিচ্ছেন না। বহুর মধ্যে একের সাধনা ও একের ব্রহ্মজ্যোতিঃ দর্শন – বিশ্বরূপে এক
ঈশ্বরকে দর্শন এই শিক্ষা আর কোথাও নেই সনাতন ধর্মের বেদ ছাড়া। রাজা জনকের উপদেশ
পেয়ে শুকদেব মেরুশিখরে গিয়ে হাজার বছর তপস্যা করেন এবং নিজের ভিতরের যাবতীয় সংশয়
দূর করে বিমল আত্মার সাক্ষাৎকার করেন। এই সাক্ষাৎকারে সলিলকণা যেমন সমুদ্রে মিশে
যায়, তেমনি তাঁর যাবতীয় বাসনা পরব্রহ্মে লোপ পায়। এই বাসনার লোপ না পেলে কেউ সবার
হতে পারেন না। বৈদিক যুগের মুনি- ঋষিদের আলো থেকে মানুষ যখন সরে যেতে শুরু করলেন
তখনি মানুষ বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন অন্তরের ব্যবসায়িত্বিক বাসনা নিয়ে।
ভ্রষ্টপথে মানুষের ঈশ্বরকে নিয়ে সাধনা শুরু হলো এবং তাঁরা নিজেরা যেমন গোষ্ঠীবদ্ধ
হয়ে পড়লেন তেমনি তাঁরা তাঁদের ঈশ্বরকে গোষ্ঠীর মধ্যে বেঁধে রাখলেন। মানুষের কাছে
সত্য ধামা চাপা পড়ে গেলো। শুরু হয়ে গেলো সনাতন ধর্মের বিভাজন। চিরন্তন সত্যকে মেনে
না নিয়ে মানুষ ধারণাকে আশ্রয় করে তাকেই সত্যরূপ দেওয়ার চেষ্টা শুরু করলো। ফলস্বরূপ
সেই শ্রেণির মানুষ আর সবার হয়ে বিরাজ করতে সক্ষম হলেন না এবং তাঁদের ঈশ্বরও সবার
ঈশ্বররূপে প্রতিভাত হলেন না। ঈশ্বরকে নিয়ে মানুষ ব্যবসায়- বাণিজ্য শুরু করে দিলেন।
বিভিন্ন ধর্মমত গড়ে উঠতে শুরু করলো বিশ্বব্যাপী অন্ধকার রাজত্বে সামান্য আলোর
ছোঁয়ায়। যারা সত্যমুখী হয়ে সাধনা করতেন তাঁদের মুখ ঘুড়িয়ে দেওয়া হলো মিথ্যার দিকে।
মানুষ নিজেকে সবার ভাবতে ভুলে গেলো, নিজেকে ভাবতে শুরু করলো কোন একটি দল- গোষ্ঠী-
ধর্ম- মত ইত্যাদির মানুষ রূপে। ফলস্বরূপ তাঁদের অন্তরের ঈশ্বরও ক্ষুদ্র রূপ পেয়ে
কুল দেবতা, গোষ্ঠী দেবতা, ধর্ম দেবতা হয়েই রয়ে গেলেন। শুরু হয়ে গেলো নিজের ধর্মের-
নিজের মতের- নিজের গুরুর প্রধান্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা। আর্য ঋষিদের একদা সারা
বিশ্বেই প্রধান্য ছিল। আর্য ঋষিগণ এই
অনাচার দেখে অবৈদিক ভাবধারার মানুষকে অনার্য রূপে গণ্য করে ত্যাগ করেন। শুরু হয়ে
যায় আর্য ও অনার্যদের মধ্যে অস্তিত্বের লড়াই। মহাভারত তখন ভারত হয়ে যায় আর্যদের
কাছে। বিশ্বব্যাপী যে বৈদিক সভ্যতা তা ক্ষুদ্র রূপ পেতে পেতে শেষ হয়ে যায়
সিন্ধুনদের তীরে। মুনি –ঋষিদের সন্তানরা নিজের ঐতিহ্য হারাতে থাকেন ঘন ঘন
অনার্যদের আক্রমনে। ভারত বলতে তখন সারা পৃথিবীকে বুঝাতো। সেই ভারত ভাগ হতে শুরু
করলো এবং বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু আর্য ঋষিদের সন্তানরা ভুলে যান নি
তাঁদের বেদকে- তাঁদের সংস্কৃতিকে। তাই তাঁরা এখনো বেদের আলোতে আলোকিত করে মানুষকে শিক্ষা
দিয়ে চলেছেন—তোমরা নিজের দৈব শক্তিকে জাগিয়ে তুলে, নিজেকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে
দাও, তাহলেই দেখবে তোমার ঈশ্বরও সবার ঈশ্বর হয়ে যাবেন। তখন আর ধর্ম নিয়ে কেউ
বাড়াবাড়ি করবে না – সারা বিশ্বে এক ঈশ্বরের অধীনে এক বিশ্বপরিবার হয়ে তখন কাজ
করবে। জয় বেদ যজ্ঞের জয়।