[ বেদ যজ্ঞ
করে জানিয়ে দাও বিশ্বমানব শিক্ষা বিশ্বের সব মানুষের অন্তরের
বন্ধ দুয়ার খুলে দেওয়ার শিক্ষা]
পৃথিবীর বুকে ৮৪ লাখ প্রজাতি জীবের মধ্যে মানুষ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে আচার-
আচরণে এক উন্নত শ্রেণির জীব রূপে প্রকাশিত হয়েছে –দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে।
পৃথিবীর বুকে মানুষের ভাল-মন্দের কাজের হিসাব লেখা থাকে ইতিহাসের পাতায়। এই
কর্মপীঠস্থান ও জ্ঞানপীঠ স্থানে এসে মানুষকে জ্ঞান লাভ করতে হয় কর্মের মাধ্যমে।
কর্ম ছাড়া ধর্ম নাই। ধর্ম ছাড়া জ্ঞান ও জীবন নাই। যে জ্ঞানের দ্বারা বিশ্ব-
ব্রহ্মাণ্ডকে কোন এক শক্তি ধারণ করে আছেন তিনি ধর্ম। কোন শক্তি এই ব্রহ্মাণ্ডকে
পরিচালনা করছেন—তাঁকে জানাটাই মানুষের ধর্ম। অজ্ঞানতার বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসার
একটাই মন্ত্র এক শক্তি সর্বভূতে বিরাজমান তা অন্তরে গেঁথে নিয়ে সর্বদায় সর্ব
প্রকার কর্ম সেই সর্বশক্তিমানের উদ্দেশ্যে করা। এখানে বিভিন্ন জাতির জন্য বিভিন্ন
শক্তির কোন স্থান নেই। এক শক্তি বিভিন্ন নামে অবস্থান করছেন সৃষ্টির প্রারম্ভকাল
থেকে। স্বামী বিবেকানন্দ সারা বিশ্ব পরিভ্রমণ করে বিভিন্ন মত পথের কথা বলেছেন—পরিশেষে
সমস্ত মত পথকে খণ্ডন করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন---
শুণ বলি মরমের কথা, জেনেছি জীবনে সত্য সার
তরঙ্গ আকুল ভবঘোর এক তরী করে পারাবার।
মন্ত্র তন্ত্র প্রাণ নিয়মন, মতামত দর্শন
বিজ্ঞান,
ত্যাগ ভোগ, বুদ্ধির বিভ্রম, প্রেম প্রেম
এইমাত্র ধন।
ব্রহ্ম হতে কীট পরমাণু সর্বভূতে সেই প্রেমময়—
মন প্রাণ শরীর অর্পণ করো সখে সে সবার পায়।
বহুরূপে সন্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছো ঈশ্বর
জীবে প্রেম করে যেই জন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।।
স্বামী বিবেকানন্দের উপলব্ধি ও জ্ঞান অনুসারে বিশ্বের প্রত্যেক মানুষকে
জ্ঞান লাভ করতে হবে জীবে প্রেম ও সেবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীতে
অধিকাংশ মানুষ অখণ্ড প্রেম ও সেবাকে বাদ দিয়ে খণ্ড খণ্ড সংসারের উদ্দেশ্যে শিক্ষা
লাভ করছে। সেই শিক্ষা বাণিজ্যিক শিক্ষা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, দেশনেতা সহ
বিশ্বের সকল মানুষ ছুটে চলেছে বাণিজ্যিক মনোভাব নিয়ে শিক্ষার জগতে, প্রতিযোগিতার
জগতে। কে কত বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, দেশনেতা হয়ে ভদ্রতার মুখোশ পড়ে হত
দরিদ্র মানুষকে পিছনে ফেলে অর্থ উপার্জন করতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে। এই শিক্ষাকে
কি আমরা মানুষের শিক্ষা বলবো? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—“যে শিক্ষা বাহিরের উপকরণ তাহা
বোঝাই করিয়া আমরা বাঁচিব না, যে শিক্ষা
অন্তরের অমৃত তাহার সাহায্যেই আমরা মৃত্যুর হাত এরাইব।“ অন্তরের শিক্ষায় হচ্ছে
সত্য জ্ঞান। অন্তর আলোকিত না হলে অজ্ঞানের অন্ধকার দূর হয় না। তাই সকল মানুষের
প্রার্থনা হওয়া উচিত---
অসতো মা সদগময়ু- তমসো
মা জ্যোতিঃরগময়ু।।
যার বাংলা অর্থ—অসৎ
হইতে মোরে সৎ পথে নাও।
জ্ঞানের আলোক জ্বেলে আঁধার ঘুচাও।।
মরণের ভয় যাক অমর কর।
দেখা দিয়ে ভগবান শঙ্কা হর।।
ঈশ্বর, গড, ভগবান, আল্লা
ইত্যাদি নাম সেই এক মহাশক্তির নাম। তিনি ছাড়া অন্য কেউ মানুষের গুরু হয়ে অন্তরের
অজ্ঞান বা অন্ধকার দূরীভূত করতে পারেন না। তিনি ছাড়া কেউ মানুষের অন্তরে জ্ঞানের
প্রদীপ জ্বালাতে পারেন না। তাঁর কৃপা হলে মানুষ নিজ জ্ঞানের আলোতে সর্বভূতে তাঁকে
দর্শন করেন। তাই সর্বাগ্রে মানুষকে নিজের মনটাকে সেই ঈশ্বরের মনের সঙ্গে যুক্ত
করতে হবে। তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে বলতে শিখতে হবে—
চাহিনা ছিঁড়িতে এক
বিশ্বব্যাপী ডোর
লক্ষ কোটি প্রাণী সাথে
এক গতি মোর।
বিশ্ব যদি চলে যায়
কাঁদিতে কাঁদিতে
আমি একা বসে রব মুক্তি
সমাধিতে।। --রবীন্দ্রনাথ
কে কি করছে তা দেখে আমার লাভ নেই। আমাকে আমার
লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। মানুষকে অনুকরণ করতে গেলে প্রতি পদে পদে বিপদ আসবে। ঈশ্বরকে
অনুকরণ করতে গেলে প্রতি পদে পদে এগিয়ে যাবে তাঁর আনন্দময় জগতে। তিনি এই পৃথিবীকে
দুঃখের জগৎ রূপে সৃষ্টি করেন নি। তিনি এই পৃথিবীকে আনন্দের জগৎ রূপে সৃষ্টি করে
মানুষকে নিমন্ত্রণ করেছেন তাঁর কর্মযজ্ঞ সম্পূর্ণ করার জন্য। তাই রবীন্দ্রনাথের
কথায় বলতে হয়---“জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ। ধন্য হলো, ধন্য হলো মানব জীবন।“
এই পৃথিবীতে যজ্ঞ অর্থাৎ কর্মের ভার ঈশ্বর মানুষের হাতে সঁপে দিয়েছেন তাঁর অন্তরে
নিজে আত্মারূপে অবস্থান থেকে। এই তত্ত্ব জেনেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন---“তোমার যজ্ঞে
দিয়েছো ভার বাজাই আমি বাশি”।
তাই মানুষকে সর্বাগ্রে জানতে হবে তিনি এই
পৃথিবীতে কার জন্যে কর্ম করে চলেছেন। কে তাকে কর্ম করার অধিকার দিয়েছে? এই তত্ত্ব
জানতে হলে অন্তরকে নির্মল ও পবিত্র করে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করতে হবে---
অন্তরমম বিকশিত করো
অন্তর তর হে।
নির্মল করো, উজ্জ্বল
করো
নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নিরলস,
নিঃসংশয় করো হে।
অন্তর মম, বিকশিত করো,
অন্তর তর হে।
মনকে সংকীর্ণতার উর্দ্ধে উঠিয়ে ব্যাপ্তির
উদ্দেশ্যে নিয়ে চলো—দেখতে পাবে ঈশ্বরের সৃষ্টির মাঝে কেউ তোমার কাছে তুচ্ছ নয়, কেউ
তোমার শত্রু নয়। সকলেই এক শক্তির আধার। সর্বভূত ঈশরকে ঘিরে রয়েছেন। তাঁকে ছাড়া
ব্রহ্মাণ্ডের কোন অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। তিনি সৃষ্টি—স্থিতি—লয়ের মাধ্যম
দিয়ে এই জগত সংসারকে ধরে রেখেছেন ও তাঁর কর্মযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছেন। “বিছমিল্লা
হির-রহমা-নির রাহীম, আর-রাহামা –নির রাহীম’’। যিনি পরম দয়াময় ও অতি দয়ালু, পরম
দাতা দয়ালু আল্লাহর নামে- তাঁর জন্য কর্ম করে মানুষ জ্ঞান লাভ করবেন ও তাঁর
উদ্দেশ্যেই কেবল কর্ম করবেন। আল্লা-হু-ইলা-হা-ইল্লা-হু-অ আল হাইয়্যুম---ইত্যাদি।
আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নাই, তিনি চিরিঞ্জীব ও সর্ব বিধাতা, তাঁকে তন্দ্রা
বা নিদ্রা স্পর্শ করতে পারে না, আকাশ পৃথিবীতে যা কিছু বিদ্যমান সবই তাঁর
নিমিত্তে। কে আছে এমন যে তাঁর অনুমতি ভিন্ন সুপারিশ করবে তাঁর নিকট? তিনি
সুপরিজ্ঞাত যা বর্তমান এবং ঘটিবে ভবিষ্যতে, তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত তাঁর জ্ঞান
ভাণ্ডারের কিছু কেহ আয়ত্ব করতে সক্ষম নহে, আকাশ পৃথিবীর সর্বত্র তাঁর আসন
পরিব্যাপ্ত, ইহাদের হেফাজতে তাঁকে ক্লান্ত করে না, তিনি মহান বিরাট। পবিত্র
কুরআনের এই মহামূল্যবান জ্ঞানটাকে হৃদয়ে ধরে রেখে যে কোন মানুষ নির্ভয়ে তাঁর
উদ্দেশ্যে কর্ম করে জ্ঞান লাভ করে আল্লাহর পরম বন্ধু হয়ে উঠতে পারবেন। আল্লাহ
ঈমানদারদের পরমবন্ধু। তিনি তাগিদে তাদের নিয়ে আসেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে।
অবিশ্বাসীদের অভিভাবক হলো শয়তান, তারা তাদের নিয়ে যায় আলো হতে অন্ধকারের দিকে। তাই
পবিত্র কুরআন –এর বাণী অন্তরে গেঁথে নিয়ে মানুষকে সৎ ও কল্যাণের পথে চলতে হবে।
পাপীর সংসর্গে পাপ
বাড়ে নিতি নিতি।
পুণ্যজনের সঙ্গে হয়
পুণ্যের সংহতি।।
বন্ধু ও পথ প্রদর্শক করো আল্লাহকে বা ঈশ্বরকে।
তিনিই একমাত্র তোমাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারেন। সেই ঈশর বা আল্লাহ হচ্ছেন
তোমার অন্তরাত্মা। তাঁকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করবে না তাহলেই নিজেই ফাঁকিতে পড়ে
যাবে। তিনি সর্বভূতে বিরাজমান। তাই তিনি বাসুদেব। তিনি সর্বব্যাপী বিস্তার লাভ করে
আছেন তাই তিনি বিষ্ণু। তাই তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে –“ বিদ্যাবিদ্যে ভবান
সত্যম অসত্যং ত্বং বিষামৃতে”। তাই অন্তরাত্মাকে বিশাল করে সর্বভূতে ঈশ্বরকে দর্শন
কর। তিনি সকল মানুষের উদ্দেশ্যে গীতাতে বলেছেন---
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র
সর্বং চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি
সঃ চ মে ন প্রণশ্যতি।।
যিনি আমাকে সর্বভূতে
অবস্থিত দেখেন এবং আমাতে সর্বভূত অবস্থিত দেখেন, আমি তাহার অদৃশ্য হই না, তিনিও
আমার অদৃশ্য হন না।
ঈশ্বর সকল জীবের অন্তরাত্মা। এই জ্ঞান লাভ করে
ঈশ্বরের কর্ম করা অর্থাৎ জীবের সেবা করা মানুষের ধর্ম। কর্ম পদ্ধতি বা উপাসনা
পদ্ধতি দেশ-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু উদ্দেশ্য সকলের একটিই--।
তাই গীতাতে শ্রী শ্রী ভগবান নিজ মুখে ব্যক্ত করেছেন----
যে যথা মাং
প্রপদ্যন্তে তাং স্তথৈব ভজাম্যহম।
মম বর্ত্মানুবর্তনতে
মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।
হে পার্থ, যে আমাকে
যেভাবে উপাসনা করে, আমি তাহাকে সেই ভাবেই
তুষ্ট করি। মনুষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথেরই অনুসরণ করে অর্থাৎ মনুষ্যগণ যে পথই
অনুসরণ করুক না কেন, সকল পথেই আমাতে পৌঁছাতে পারে।
গীতার এই অভয়বাণী সকল মানুষের জন্যে। উপাসনা
পদ্ধতি বা কর্মপদ্ধতি আলাদা আলাদা হলেও সকলেই যে এক ঈশ্বরের জন্যে কর্ম করে চলেছে
তা ঈশ্বর নিজ মুখে স্বীকার করেছেন। তাই তো শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণ দেব বলেছিলেন--- যত মত
তত পথ। কালী, খীষ্ট, আল্লা, কৃষ্ণ সব এক। পানি, জল,water যেমন এক বস্তু তেমনি ঈশ্বর, আল্লা, গড, কৃষ্ণ, বিষ্ণু
সব নাম এক শক্তির ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও ভাবের নাম। তাই মানুষ যখন সবকিছু ভুলে কেবল
তাঁর পথের অনুসরণ করবে তাঁর বিধান মেনে কর্ম করবে তখন-ই সে তাঁর কৃপা লাভ করে তাঁর
জ্ঞান লাভ করবে। একমাত্র ঈশ্বর হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক, শ্রেষ্ঠ বিচারক, শ্রেষ্ঠ
জ্ঞানী, শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান, শ্রেষ্ঠ শক্তিমান, শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও
শ্রেষ্ঠ অভিভাবক তাই তিনিই সকল মানুষের গুরু। তাঁর কাছে দীক্ষা নিয়ে তাঁর নির্দেশ
ও আদেশ পালন করাই মানুষের ধর্ম ও কর্তব্য। একজন শিক্ষক যতক্ষন না ঈশ্বরের
প্রতিনিধি রূপে নিজেকে তুলে ধরতে না পারবেন ততক্ষন পর্যন্ত তিনি আদর্শ শিক্ষক হতে
পারবেন না। একইভাবে সকল মানুষকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে নিজ নিজ কর্তব্য কর্ম করে
যেতে হবে। এই শিক্ষায় আমরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে পেয়ে আসছি। গীতায় ভগবান বলেছেন—
ময়ি সর্বানি কর্মানি
সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।
নিরাশীনির্মমো ভূত্বা
যুধ্যস্ব বিগতজ্বর।।
কর্তা ঈশ্বর, তাঁহারই
উদ্দেশ্যে সকলে ভৃত্যবৎ কর্ম করিতেছে। এইরূপ বিবেক-বুদ্ধি সহকারে সমস্ত
কর্ম আমাতে সমর্পণ করিয়া কামনাশুন্য ও মমতাশুন্য হইয়া শোক ত্যাগ পূর্বক তুমি যুদ্ধ
বা কর্ম কর।
কর্তব্য কর্ম করাটাই
ধর্ম। বিদেশীয় ভাষায় অনুবাদকগণ সকলেই স্বধর্মের অর্থ করেছেন কর্তব্য কর্ম। যথা—‘To die performing duty is
no ill. But who seeks other roads shall wander still.[Arnold in The song
celestial]
‘Better death in the discharge of one’s own duty; the
duty of another is full of danger.’—Annie
Besant. স্বধর্ম বা কর্তব্য পালন না করলে মানুষের গুণের প্রকাশ হয় না। ফাঁকি দিয়ে
কেউ জ্ঞান লাভ করতে পারে না। কর্তব্য কর্মে অনর থেকে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে মানুষকে
মনুষ্যত্বের গুণের প্রকাশ-বিকাশ ঘটাবার চেষ্টা করতে হয়। কখনও সুখের আশা করে
কর্তব্য কর্ম থেকে বিচ্যুৎ হওয়া মানুষের ধর্ম বা কর্ম নয়—তাই বলতে হয়— ‘I slept
and dreamt that life was beauty,
I woke and found that
life was duty.’ নিদ্রায় দেখিনু হায়,- মধুর স্বপন-
কি সুন্দর সুখময় মানব
জীবন। জাগিয়া মেলিনু আঁখি, চমকিনু পুনঃ দেখি—কঠোর কর্তব্য ব্রত জীবন যাপন।‘
[প্রভাত চিন্তা]
আজ মানুষ সুখের পিছনে
ছুটতে গিয়ে দুঃখের বোঝা বইছে। অমৃত ছেড়ে দিয়ে গরল পান করছে। এই ভারতের কত মুনি
ঋষির অমৃত বাণীকে ফেলে দিয়ে বিদেশ থেকে বিষের থলি আমদানি করে সকলকে গিলাবার চেষ্টা
চলছে। ধর্মকে বলা হচ্ছে আফিং এর নেশা। ঈশ্বরকে বলা হচ্ছে মৃত। সেই জন্য আমাদের
পবিত্র মঙ্গলঘট ভরা আর হচ্ছে না। বিশ্বকবির আহ্বান কবে সফল হবে—
মার অভিষেকে এস এস
ত্বরা
মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা—
সবার পরশে পবিত্র করা
তীর্থনীরে
এই ভারতের মহামানবের
সাগর তীরে।
জ্ঞান দ্বারা মঙ্গলঘট
পূর্ণ না হলে মানব জীবন পবিত্র ও ধন্য হয় না – ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে মঙ্গলঘট স্থাপন
ব্যর্থ হয়। প্রত্যেক মানব দেহে ঈশ্বরের সেই জ্ঞান পবিত্র বেদজ্ঞান সুপ্ত অবস্থায়
রয়েছে। এই সত্য জেনে স্বধর্ম অর্থাৎ কর্তব্য কর্মের মাধ্যমে সেই জ্ঞানের জাগরণ
ঘটিয়ে সেই সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে অন্তরাত্মার ও মনের মিলন ঘটাতে হবে। এই জ্ঞানের
আলোতে আলোকিত হয়ে বিশ্ববোধে সদা জাগ্রত থেকে কবিগুরুর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে
হবে---
এ আমার শরীরের শিরায়
শিরায়
যে প্রাণ তরঙ্গ মালা
রাত্রিদিন ধায়,
সেই প্রাণ ছুটিয়াছে,
বিশ্ব দিগ্বিজয়ে
সেই প্রাণ অপরূপ ছন্দ
তাল লয়ে
নাচিছে ভুবনে।
বেদ-এর বিপরীত শব্দ ভেদ। তাহলে বেদ শব্দের অর্থ
জ্ঞান হলে ভেদ শব্দের অর্থ অজ্ঞান। অতএব যারা সৃষ্টির কোন কিছুকে ঈশ্বরের সৃষ্টি
বলে বিশ্বাস করে না তারা ভেদকে বিশ্বাস করে। তারাই অজ্ঞানী ও বেদবিরোধী। অজ্ঞানীরা
ঈশ্বরের গুণের কথা জানবে কি প্রকারে? শাস্ত্রে এই সব ব্যক্তিকে অসুর, কাফের,
ধর্মহীন, শয়তান ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। যারা ঈশ্বর,আল্লা, গড বা তাঁর শক্তির
বিভিন্ন রূপকে বিশ্বাস করে, তার সৃষ্টিকে বিশ্বাস করে ও তাঁর উদ্দেশ্যে কর্ম করে
তাদের ধার্মিক, ঈমানদার, মুমিন ইত্যাদি বলা হয়। তারা বিধর্মী নামে কখনো ভূষিত হতে
পারে না। তারা সকলেই জ্ঞানী। জ্ঞানের থেকে পবিত্র আর কিছু হতে পারে না। ঈশ্বর
স্বয়ং নিজ মুখে শ্রীশ্রী গীতাতে বলেছেন—
ন হি জ্ঞানেন সদৃশং
পবিত্রমিহ বিদ্যতে।
ত্বং স্বয়ং যোগসিদ্ধঃ
কালেননাত্মনি বিন্দতি।।
ইহলোকে জ্ঞানের ন্যায়
পবিত্র আর কিছু নাই। কর্মযোগে সিদ্ধ পুরুষ সেই জ্ঞান কাল সহকারে আপনিই অন্তরে লাভ
করেন। তাই মানুষের চিন্তা শক্তিকে বৃদ্ধি করে উপলব্ধি করতে হবে মন্দির, মসজিদ,
গির্জা, গুরুদ্বার কেন নির্মাণ করা হ্যেছে।প্রত্যেক উপাসনালয়ের প্রধান উদ্দেশ্য
মানুষকে জ্ঞানী করে তোলা। তাই আমরা শ্রীমদ্ভাগবতের ৩য় স্কন্ধের শ্লোকগুলিতে
ভগবানের মুখ থেকে শুনতে পাই—
অহং সর্বেষু ভুতেষু
ভুতাত্মবস্থিতঃ সদা।
তমবজ্ঞায় সাং মর্ত্যঃ
কুরুতেহচাবিড়ম্বণম।।
যো মাং সর্বেষু ভুতেষু
স্নত্মাত্মানমীশ্বরম।
হিতাচারাং ভুজতে মৌর্যাদ্ভস্মন্যেব
জুহোতিস।।
অনুবাদঃ—আমি সর্বভূতে
ভুতাত্মস্বরূপে অবস্থিত আছি। অথচ সেই আমাকে অর্থাৎ সর্বভূতকে অবজ্ঞা করিয়া মনুষ্য
প্রতিমাদিতে পুজারূপ বিড়ম্বনা করিয়া থাকে। সর্বভূতে অবস্থিত আত্মা ও ঈশ্বর আমাকে
উপেক্ষা করিয়া যে প্রতিমাদি ভজনা করে সে ভস্মে ঘৃতাহুতি দেয়। যে প্রাণীগণের
অবজ্ঞাকারী, সে বিবিধ দ্রব্যে ও বিবিধ ক্রিয়াদ্বারা আমার প্রতিমাতে আমার পুজা
করিলেও আমি তাহার প্রতি সন্তুষ্ট হই না। সুতরাং মানুষের কর্তব্য যে, আমি সর্বভূতে
আছি ইহা জানিয়া সকলের প্রতি সমদৃষ্টি, সকলের সহিত মিত্রতা ও দান- মানাদির দ্বারা
সকলকে অর্চনা করে।
অতএব যারা মনে করেন ঈশ্বর মন্দির, মসজিদ বা
গির্জাতেই কেবল থাকেন তারা ঈশ্বরের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত নন। তিনি কোথায় নেই?
তিনি সর্বভূতে বিরাজমান। পুরোহিত ঠাকুর দেবালয়ের মূর্তিকে ঈশ্বর ভেবে ভিখারীকে দূর
দূর করে তাড়িয়ে দেন। কবির ভাষায় ভিখারী কাতর কন্ঠে দেবমন্দিরে এসে বলছে—
গৃহ মোর নাই
এক পাশে দয়া করে দেহ
মোরে ঠাই।
পুরোহিত ঠাকুর বিরক্ত
হয়ে মালা জপিতে জপিতে তাকে বলছেন—
আরে আরে অপবিত্র দূর
হয়ে যারে।
সে কহিল—চলিলাম।
চক্ষের নিমিষে
ভিখারি ধরিল মূর্তি
দেবতার বেশে।
ভক্ত কহে; প্রভু মোরে
কি ছল ছলিলে?
দেবতা কহিল; মোরে দূর
করি দিলে।
জগতে দরিদ্র রূপে ফিরি
দয়া তরে।
গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি
থাকি ঘরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ পৃথিবীর বুকে কোটি কোটি মানুষ নিরাশ্রয়।
অর্ধাহারে, অনাহারে, অশিক্ষায়, অপুষ্টিতে ভুগছে কোটি কোটি মানুষ। কতিপয় লোক
বুদ্ধিবলে তাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। এই কতিপয় মানুষ দাদাগিরি করে মানুষকে জানতে
দিচ্ছে না প্রকৃত সত্য কি—প্রকৃত ধর্ম কি—প্রকৃত ঈশ্বর বা আল্লা কে? ঈশ্বর, আল্লা,
বা গড তাদের প্রকৃত হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু হয়ে, জ্ঞানী হয়ে তার অন্তরাত্মা রূপে তার
হৃদয় মন্দিরে বাস করছে, এই কথাটি শিক্ষা দেওয়ার লোক পৃথিবীতে যেন বিরল। তাই স্বামী
বিবেকানন্দ বলেছেন—সহজ জ্ঞান যত দুর্লভ আর কিছুই তত দুর্লভ নয়।
পরিশেষে বলতে চাই—পবিত্র কুরআন, বেদ,
বাইবেল,গীতা শ্রীমদ্ভাগবত ইত্যাদি শাস্ত্র গ্রন্থ যে শিক্ষা মানুষকে দিয়ে গেছেন
সেই অমুল্য সম্পদ অন্তরাত্মাকে জাগরণের মন্ত্র স্বরূপ। এই শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ
মানুষের মাঝে অমরত্ব লাভ করে বেঁচে থাকে। এই শিক্ষা পেলেই মানুষ কবির কন্ঠে বলে
উঠবেন—
মরিতে চাহি না আমি এ
সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি
বাঁচিবারে চাই।
কবি মানুষের মাঝে
বেঁচে আছেন মানুষের জয়গান করে। তাই সকলকে অমর হতে হবে অমৃত পান করে। ‘যত্র জীব
তত্র শিব’ এই বেদ মন্ত্র হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে সর্বদায় বলো—সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার
উপরে নাই। মানুষের হৃদয়ে ঈশ্বর রয়েছেন এই
সত্য আগে জানো সবাই। তারপরে সদায় গাইতে থাকো এক মন হয়ে- এক প্রাণ হয়ে সেই গান—মানুষ
হবার জন্য—
স্বাধীন করেছ মোদের
এবার মানুষ করিয়া দাও মা।
চিরকল্যাণ পথে আমাদেরে
হাতে ধরে তুমি নাও মা।।
ধ্রুব, নচিকেতা,মদালিসা,
সীতা তোমারি কৃপায় জনমিলা যেথা,
শত মহাবীর জনমিবে সেথা
তুমি যদি ফিরে চাও মা।।
ঊর্ধ্ব গগনে উরাল
যাঁহারা নব ভারতের জয় নিশান।
তাঁদের মহান ত্যাগের
কণিকা জীবনে মোদের কর মা দান।
নাহি জাগে যদি মোদের
জীবন, স্বাধীনতা শুধু হবে বিড়ম্বন,
দাও মা মোদের মানুষের
মন, চরণে শরণ দাও মা।। জয় বিশ্বমানব শিক্ষার জয়