[ভারত দর্শন ও জীবন দর্শন]
আজকে বিশ্বমানব শিক্ষা সেমিনারে আমি ভারত দর্শন
ও জীবন দর্শন নিয়ে কিছু গুরত্বপূর্ণ আলোচনা করতে চাই। যে সব আলোচনা বিশ্বের
প্রতিটি মানুষকে নূতন পথ দেখাবে। বুদ্ধ, শংকর,চৈতন্য, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ,
ঋষি অরবিন্দ, মহাত্মা গান্ধী, সুভাসচন্দ্র, হজরত মহম্মদ, আব্দুল গফুরখান, মহসীন
প্রভৃতি মনীষী কোথা থেকে সত্যজ্ঞান লাভ করে মৃত্যুকে জয় করেছিলেন এবং তাঁরা
প্রতিটি মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন। তাঁদের জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমরা দেখতে
পাবো, তাঁরা কেউ নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের কোন ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতাকে নিজ নিজ
জীবনে প্রশ্রয় দেন নি। যা সত্য ও সুন্দর তাকে নির্ভয়ে প্রকাশ করেছেন। শাশ্বত সনাতন
মানব ধর্ম বা শিক্ষার উপর নির্ভর করেই তাঁদের জীবন দর্শন গড়ে উঠে। তাঁরা মানব
জাতির উদ্দেশ্যে যে বার্তা দিয়েছেন তা অতি প্রাচীন। তাঁরা সকলেই বেদ- উপনিষদ,
পবিত্র কুরআন – গীতাকে আশ্রয় করেই জীবন শুরু করেন এবং সেই সত্যকে সর্বত্র তুলে
ধরেন। মানব দেহকে ঘিরে যে আত্মা রয়েছে, সেই আত্মা এক ও অমর। সেই আত্মার ধ্যান ও
সেই আত্মার জ্ঞান নিয়েই তাঁরা মহান হয়ে উঠেন। তাই প্রথমেই বলতে হয়—অজ-অমর আত্মার
ধ্যান করলে ও তাঁর সঙ্গ করলে, মানুষ মৃত্যুভয় জয় করে অমরত্ব লাভ করে। তাই প্রথমেই
মনে জ্বলন্ত বিশ্বাসকে দৃঢ় করতে হবে যে, সে নিজে এবং আত্মা অভিন্ন। অমরত্ব লাভের
বীজ এবং কৌশল এটাই। শাশ্বত জীবনকে জানাটাই হচ্ছে ভারত দর্শন।
নানাত্ব বা বিভিন্নতা মন ও দৃষ্টির ভ্রান্ত দিক। আপাত দৃষ্টিতে তা সত্য মনে
হলেও তা মূলত কখনও সত্য নয়। মূল সত্য, ব্রহ্ম বা আত্মাতে কখনও নানাত্ব থাকে না।
দৃষ্টিতে নানাত্ব প্রশ্রয় পেলে বুঝতে হবে, জীবনের চরম ও পরম সত্য ব্রহ্ম উপলব্ধি
এখনও ঘটেনি। যিনি চিত্তের যাবতীয় দ্বৈততাকে এভাবে নিরুদ্ধ করতে পারেন, তিনি যাবতীয়
মান-অপমান, সুখ—দুঃখ ,লাভালাভ, ভালমন্দের পারে চলে যান; তিনি পরম সত্য জ্ঞান লাভ
করে মুক্ত হন—এটাই ভারত দর্শন। ভয়হীন নির্ভয় হয়ে জীবনপথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে – এই
দর্শন।
ত্যাগের মধ্য দিয়ে ভোগ করতে হয়। অধিকার করে, আয়ত্ত করে, বিষয় বস্তু ইত্যাদি
যথার্থ ভোগ করা যায় না। আপাত দৃষ্টিতে তা আনন্দদায়ক ও সুখকর হলেও- সে ভোগ ক্রমবর্ধমান অশান্তিকর।
ত্যাগের মধ্য দিয়ে ভোগ চিত্ত প্রশান্তিকারক। এটাই ভারতিয় জীবন দর্শন।
এক জ্যোতিই সর্বব্যাপী অবস্থান করছেন। সেই
জ্যোতির উপাসনা দ্বারা মানুষ সমুজ্জ্বল
জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেন। এই অবস্থায় মানুষের জ্ঞানময় ও আনন্দময় অবস্থা। এই শিক্ষায়
ভারতীয় শিক্ষা ও জীবন দর্শন।
পরমেশ্বর পরমপিতা বা বিশ্বপিতা দ্বারা সমাবৃত
হল জগদব্রহ্মান্ডের এই সবকিছুই। তাই তুমি ত্যাগের
দ্বারা ভোগ কর, কারও ধনে লোভ কর না।অর্থাৎ জগদব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই যখন
বিশ্বপিতার অধিকারে, তখন তুমি নিজের বলে কোনও কিছুকে কুক্ষীগত করতে যাবে কোন
সাহসে? বিষয় ভোগ যতকিছু তোমার সামনে আসছে, নির্লোভ ও নিরাসক্ত চিত্তে ত্যাগ-
ভাবনার মধ্য দিয়ে সেগুলির যথাযোগ্য উপভোগ
মাত্র কর। এই জ্ঞানের দ্বারা-ই ভারতবর্ষ শাসিত হতো। তাই ভারতবর্ষ কোনদিন অন্যদেশের
উপর আক্রমণ হানে নি। সারা পৃথিবীর মানুষকে তারা আত্মীয় ভাবে। এটাই ভারতের জীবন
দর্শন।
তাই প্রার্থনা
করি—হে পরমপিতা – হে বিশ্বপিতা আমার বাক্য যেন মনে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমার মন যেন
বাক্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে, অর্থাৎ আমি যেন মন ও মুখ সর্বদা এক করে রাখতে পারি। আচরণে
আমি যেন সদা সত্যরক্ষা করে চলতে পারি। মনে প্রাণে যেন আমি সদায় সত্যনিষ্ঠ হয়ে
থাকি। আমার তেজস্বী ও দীপ্তিমান আত্মা সর্বত্র বিরাজমান তা জেনে আমি যেন সর্বদায়
আনন্দময় জগতে বিরাজ করি। আমরা পরস্পরের প্রতি কখনই যেন বিদ্বেষভাব পোষণ না করি।
পরিশেষে বলি-----
হে মোর
দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।
আমার নয়নে তোমার বিশ্বছবি
দেখিয়া লইতে সাধ যায় তব কবি
আমার মুগ্ধ শ্রবণে নীরব রহি
শুনিয়া লইতে চাহ আপনার গান।
হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।