বেদ যজ্ঞ
সম্মেলনঃ—১৬/ ০৭/ ২০১৬ স্থানঃ—ঘোড়শালা* মুর্শিদাবাদ* পঃ বঃ
আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ—[ বেদ যজ্ঞ বা ধর্ম
যুদ্ধের বিধান ঈশ্বর মানুষকে দিয়েছেন কিন্তু মানুষের কাছে এই বিধান অপছন্দ, কিন্তু
মানুষ যা পছন্দ করে না সম্ভবত তাই কল্যাণকর আর যা পছন্দ করে তা তাদের জন্য
অকল্যাণকর।]
মানুষের অন্তরে রয়েছে বেদের খনি। এই খনি
আগ্নেয়গিরি থেকেও ভয়ংকর। এখানকার তেজ নিয়েই মানুষের বিক্রম। মানুষ এই তেজ নিয়ে
সৎকাজ, আত্মসংযম ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে পারে, আবার এর বিপরীত কাজ করে
ধ্বংসকে ডেকে আনতে পারে। যারা ধর্মযুদ্ধের অন্তর্হিত অর্থ হৃদয়গম করে আত্মার উপর
ভর করে শান্তির জগৎ রচনার দিকে এগিয়ে যায় না, তারা কখনো এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারে
না। ধর্মযুদ্ধ করে ঈশ্বরের রাজত্বে শান্তি স্থাপন করতে হয়। এই রাজত্ব বিশাল--এর
শুরু ও শেষ কোথায় কেউ তা জানে না। অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এই ধর্মযুদ্ধ চলে এবং সেই
সব ব্রহ্মাণ্ডকে জয় করে সেখানকার সম্পদ এনে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার বিধান
দেওয়া হয়েছে এই পৃথিবীর রথী- মহারথীকে। বেদের যুগের মুনি –ঋষিরা ছিলেন এক একজন এই
ধর্মযুদ্ধে রথী- মহারথী। তাঁরা কেউ ধর্মযুদ্ধ লব্ধ সম্পদকে নিজের সম্পদ ভেবে নিজের
ঘরে আবদ্ধ করে রাখতেন না। তারা তাঁদের ধর্মযুদ্ধের লব্ধ সম্পদ দিয়ে বেদের রাজত্ব
গড়ে তুলতেন এবং সেই মুল্যবান সম্পদগুলি জগতের সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে
দিতেন। এই রথী- মহারথীদেরকে ধর্মযুদ্ধে ময়দানে দেখা গেছে নানাভাবে অসুরশক্তির সাথে
যুদ্ধ করতে এবং তাঁদেরকে পরাস্ত করার জন্য দেবশক্তির সাহায্য গ্রহণ করতে। আসুরিক
সম্পদকে ধ্বংস করে দৈবী সম্পদের দ্বারা নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁদের
মুল লক্ষ্য। এই ধর্মযুদ্ধ করতে গিয়ে ও পরমেশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে একজন
মানুষ তো দূরের কথা একটি প্রাণিও তাঁরা হত্যা করতেন না। তাঁরা জানতেন ঈশ্বর
বিশ্বজগতের প্রতি মঙ্গলময়, তিনি সর্ব দ্রষ্টা, তিনি সর্ব শ্রোতা, সর্বজ্ঞ। তাঁকে
ঘিরে ধর্মযুদ্ধে কোন অন্যায় করা বা কাউকে অন্যায়ভাবে বধ করা যায় না। তাহলে সেই
ধর্মযুদ্ধ অধর্মে পতিত হয়। ঈশ্বর যাকে খুশী এই যুদ্ধে জয়ী ঘোষণা করে তাঁর রাজত্ব ও
জ্ঞান-বিজ্ঞান দান করবেন। ধর্মযুদ্ধে এই সম্পদ যিনি লাভ করলেন তিনি তাঁর রাজত্বের
সকল সম্পদের অধিকার লাভ করলেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রজা সৃষ্টি করে চতুর্মুখে এ
বিশ্বের চারদিকে চারশ্রেণির মানুষকে বেদ শিক্ষা দান করলেন এবং তাঁদের সকলকে
ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে বেদের রাজত্ব গড়ে প্রজা বৃদ্ধির নির্দেশ দিলেন। ঋক- সাম- যজু
ও অথর্ব বেদের বাণী সৃষ্টির সাথে সাথে মানব জাতি লাভ করলেন, এটাই মানব জাতির সনাতন
শিক্ষা। মানব জাতি এই বেদকে অন্তরে ধারণ করে নিলেন অতি যত্নে। এই বেদকে আশ্রয় করেই
চললো তাঁদের বিশ্বজয়ের জন্য ধর্মযুদ্ধ। এই পৃথিবীতে মানব জাতির সৃষ্টির পর থেকে কত
বার চার প্রান্তের রথী- মহারথী এই বিশ্ব ধর্মযুদ্ধে সামিল হয়েছেন ও সারা বিশ্বে
বেদের ও সত্যযুগের প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেই সাথে মানবজাতিকে এক মঞ্চে এনে এক জাতি-
এক নীতির প্রতিষ্ঠা করেছেন তা আমাদের আজ অজানা। কারণ তা কালের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে
যায়। কাল সবায়কে ধ্বংস করতে পারে কিন্তু সত্যকে ধ্বংস করতে পারে না। আমরা বর্তমান
বিজ্ঞানের সভ্যতার যুগে বাস করেও মানব সভ্যতার প্রাচীনতার সামান্য টুকুও জানি না।
একটা উদাহরণ দিলেই বুঝা যাবে—রামায়ণ বাল্মীকি মুনি রচনা করেছিলেন রামের আবির্ভাবের
দশ হাজার বছর পূর্বে। এই রামায়ণ রচনার দশ হাজার বছর পর শ্রীরামের আবির্ভাব হয়। তার
বহু পূর্বে রামের কথা মানব সভ্যতায় প্রচলিত ছিল বলেই কিন্তু রত্নাকর দস্যু রাম নাম
নিয়ে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তাহলে এখানে প্রমাণ হচ্ছে মানব সভ্যতায় রামের আবির্ভাব
কতবার ঘটেছে তা আমরা কেউ জানি না। কিন্তু রামের বীজ রয়ে গেছে মানুষের অন্তরে। তেমনি মানব সভ্যতা কেনো এই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও বেদের বীজ ধ্বংস করতে পারেনা
মহাকাল। এই পৃথিবিতে বেদ- বাইবেল- গীতা- চণ্ডী- রামায়ণ- মহাভারত- কুরআন-
ত্রিপিটক- আবেস্তা- ইলিয়াড- ওডিসি যত শাস্ত্র গ্রন্থ আছে সবই মানুষকে ধর্মযুদ্ধ
শিক্ষা দিয়ে ধার্মিক করার জন্য ও উন্নত মানবিক- ধার্মিক চরিত্র গঠন করে উন্নত
ঈশ্বরের রাজত্ব গঠন করে মানুষকে ঈশ্বরের গুণে গুণাম্বিত করে তোলার জন্য। কখনো এসব
শাস্ত্র গ্রন্থ মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি বা মানুষে মানুষে লড়াই করার জন্য
অবতীর্ণ হয়নি। জয় বেদ যজ্ঞের জয়।