বেদ যজ্ঞ সম্মেলনঃ—১১/ ০৭/ ২০১৬ স্থানঃ—ঘোড়শালা* মুর্শিদাবাদ* পঃ বঃ
আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ—[
বেদ যজ্ঞ করেই মানুষকে বেদের সোমলতা ছেঁচে তার রস বের করে তাকে ছেঁকে পরিশুদ্ধ করে
সোমরস পান করতে হয়।]
অনেকেই ধারণা বৈদিক ঋষিরা সোমরস
নামে একপ্রকার উত্তেজক মদিরা পান করতেন ঠিক যেমন বর্তমানকালে মানুষ মদ নামক এক
উত্তেজক পানীয় পান করেন। এই সমস্ত ব্যক্তির বৈদিক ঋষিদের জ্ঞানের সম্পর্কে
সামান্যতম ধারণা নেই। সোম রস নিয়ে বেদে অনেক মন্ত্র ও গীত আছে। প্রত্যেকটি মন্ত্র
ও গীত আত্মিক রসে পরিপূর্ণ। ঋক বেদের এক মন্ত্রে বলা হয়েছে—“ ন যস্য দ্যাবাপৃথিবী
ন ধন্ব নান্তরিক্ষং নাদ্রয়ঃ সোমো অক্ষাঃ”। এর বাংলা অর্থ – সোমের অনন্ত মহিমা
পৃথিবী, অন্তরীক্ষ, স্বর্গও অনুধাবন করতে পারে না। পর্বত এর মহিমা স্পর্শ করতে
পারে না। সোমধারা আত্মার অন্তর্নিহিত দিব্য আনন্দ। সোমরস হচ্ছে তুরীয়ানন্দ,
অমৃতত্ব—আনন্দ অমৃতম। বেদ বৃক্ষে এই সোমলতার জন্ম। ঋষিরা এই বৃক্ষ থেকে সোমলতা
তুলে তাকে ছেঁচে রস বের করতেন এবং তা দেবতাদের উদ্দ্যেশে উৎসর্গ করার জন্য মনোরম
করে তুলতেন। দেবতাদের উৎসর্গ করে ঋষিরা এই রস পান করে দিব্য আনন্দে ভরপুর হয়ে
থাকতেন। এই রস পানে চিন্ময় আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে স্বর্গীয় আনন্দ ধারা দেবতাদের
আশীর্বাদ হয়ে নেমে আসতো ঋষিদের প্রাণে। ঋষিরা সদায় সোমরস পান করে বলতেন—“ যো বঃ
শিবতমো রসস্তস্য ভাজয়তেহ নঃ উশতীরিব মাতবঃ”। এর অর্থ—হে রস, তোমার যে শিবতম রূপ,
আমাদের তার ভাগী কর। হে সোম তুমি আমাদের শিরে শিবতম রূপে অবস্থান কর। যে কোন খাদ্য
রসের দুটি রূপ আছে--- একটি অশিব রূপ ও অপরটি শিবতম রূপ। বৈদিক যুগের ঋষিরা
খাদ্যরসকে দেবতার প্রসাদ করে শিবময় রূপ দিয়ে তবেই তা পান করতেন এবং সেই খাদ্যরসে
জ্যোতিঃ দেখতে পেতেন। এই জ্যোতিঃই হচ্ছে সোম। এই জ্যোতিঃই হচ্ছে অমৃত। অবিদ্যা ও
মায়ার আবরণে খাদ্য রসের মধ্যে চিৎ জ্যোতি আবৃত থাকে। খাদ্যরস থেকে অবিদ্যা ও
মায়াকে ছেঁচে বের করতেন সোম, তারপর তা ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে দেবতার প্রসাদ করে সেই
সোমরসকে অমৃতময় করে তুলতেন বৈদিক যুগের মুনি ঋষিরা। এই সোমরস পান করে তাঁদের
রসচেতনাকে ঊর্ধ্বগামী করে শিবলোকে – বিষ্ণুলোকে – ব্রহ্মলোকে- সত্যলোকে নিয়ে যেতেন
ইচ্ছানুসারে। এই সোমরস পান করেই তাঁরা অমরত্ব লাভ করতেন এবং পার্থিব জগতের মোহ
থেকে মুক্ত থাকতেন। আমরা বর্তমানে এই খাদ্যরসের রহস্য ভুলে গিয়ে কেবল দেহের খাদ্য
দিয়ে দেহকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম করি। কেউ দেহমধ্যে অবস্থিত আত্মা বা পরব্রহ্মের
খাদ্যের কথা চিন্তা করি না—তাই আমরা আমাদের জীবনকে মোহময় খাদ্যের মধ্যেই আবদ্ধ করে
রাখি। কেউ সোমরস তৈরী করে সেই রস পান করে নিজ আত্মাকে সন্তুষ্ট করার দিকে এগিয়ে
যায় না। ওঁ সত্যম শিবম সুন্দরম ওঁ নমঃ শিবায়।