[ বেদ যজ্ঞের মাধ্যমে যুব নায়ক বিবেকানন্দের চিন্তা ধারাকে সবার
অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করে ভারত মাতার মান- মর্যাদাকে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করো।]
আজকে বেদ যজ্ঞের আসরে আমি সংক্ষেপে যুব নায়ক-বিবেকানন্দ নিয়ে
আলোচনা করবো। স্বামীজী ছিলেন তারুণ্যের প্রতীক, চিরতরুন। তরুণ অবস্থাতেই মাত্র ৩৯
বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তাঁর বাণী আজও বিদ্যমান হয়ে চির নূতন
রূপে উজ্জ্বল হয়ে অমরত্ব লাভ করেছে আমাদের কাছে। তাঁর বাণী সাহসের বাণী—তাঁর বাণী
বীর্যবত্তার বাণী—তাঁর বাণী উৎসাহ –উদ্দীপনার বাণী। তাঁর বাণীতে নেতি বাচক কিছু
নেই, সবই ইতি বাচক। ওঠ, জাগো, সাহস অবলম্বন কর, এই তাঁর বাণীর সার কথা। তাঁর বাণীর
মধ্যে কান্না নেই, হা-হুতাশ নেই। আছে আত্মবিশ্বসের কথা, পুরুষকারের কথা। ভয় কাকে
বলে তা তিনি জানতেন না। পিছু হটতে তিনি কখনোও শিখেন নি। তাঁর বাণী ছিল- এগিয়ে চলো,
নিজের লক্ষ্যে না পৌছুনো পর্যন্ত থেমো না। তিনি সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করতেন
দুর্বলতাকে। তিনি বলতেন- “ তোরা মানুষ হ। আমি এমন মানুষ চাই যাদের মাংসপেশি লোহা
দিয়ে তৈরী, স্নায়ুগুলি ইস্পাত দিয়ে তৈরী, আর এই দেহের মধ্যে এমন মন থাকবে যা
বজ্রের উপাদানে গঠিত”। অনেকে আমিষ –নিরামিষ
খাওয়া নিয়ে খুব তর্ক করতেন। তিনি বলতেন—আমার ছেলেরা যতখুশি আমিষ খাক, পাপ
হলে তা আমার হবে।– কেন বলতেন? কারণ তিনি চাইতেন দেশের ছেলে মেয়েরা বলিষ্ঠ,
দ্ররিষ্ঠ হোক।
শুধু
দেহ শক্ত হলে হল না, মনও শক্ত হওয়া চাই। সর্বাগ্রে চাই আত্মবিশ্বাস যাকে তিনি
শ্রদ্ধা- ভক্তি বলতেন। কে নাস্তিক? স্বামীজী বলতেনঃ পুরানো মতে যাদের ঈশ্বরে
বিশ্বাস নেই- তারাই নাস্তিক, কিন্তু আধুনিক মতে যাদের নিজেদের উপর বিশ্বাস নেই
তারাই নাস্তিক।
কে
নেতা হবে, এই নিয়ে দেশের সর্বত্র ঝগড়া লেগেই আছে। তাদেখে স্বামীজী একটা চমৎকার কথা
বলতেন। তিনি বলতেন—যে শিরদার সেই তো সর্দার, সেই তো নেতা। অর্থাৎ যে পরের জন্যে
‘শিরদার’ অর্থাৎ নিজের মাথা কেটে দিতে পারে, সেই সর্দার অর্থাৎ নেতা হতে পারে। সেই
নেতা এই ত্যাগ স্বীকার করবে ‘বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়’। অর্থাৎ দেশ ও দেশবাসীর
কল্যাণের জন্য সে ত্যাগ স্বীকার করবে। কিন্তু বর্তমান ভারতের নেতাদের দেখলে লজ্জা
ও ঘৃণা হয়—এদেরকে জনগণ কিভাবে নেতা বলে স্বীকার করে নিবেন?
স্বামীজী তরুণদের বলতেন—“তোমরা হৃদয়বান হও,
প্রেমিক হও। তোমরা কি দেখতে পাচ্ছো না – প্রাণে প্রাণে বুঝতে পারছো না—আজ ভারতবর্ষ
কোটি কোটি দেব ও ঋষির বংশধর পশুর মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে? অজ্ঞতার কালো মেঘ ভারতবর্ষকে
আচ্ছন্ন করে ফেলেছে? তোমরা সিংহের মতো তেজে দেশের সব সমস্যাগুলি সমাধান করার জন্য
এগিয়ে এসো”। এখানে কাজ করতে এসে কোন চালাকির প্রয়োজন নেই। চালাকির দ্বারা কোন মহৎ
কাজ হয় না।শুধু চাই বিশ্বাস, বিশ্বাস, সহানুভূতি, অগ্নিময় জলন্ত বিশ্বাস, অগ্নিময়
সহানুভূতি। তুচ্ছ জীবন, তুচ্ছ মরণ, তুচ্ছ ক্ষুধা, তুচ্ছ সুখ, তুচ্ছ দুঃখ, তুচ্ছ
আনন্দ নিয়ে তুমি কি করবে? নিজের উপর জলন্ত বিশ্বাস স্থাপন কর—মহৎ হবার জন্য
সংগ্রাম কর—এইটাই তো তোমার জীবন। সেই
বিশ্বাস বলে নিজের পায়ে দাঁড়াও বীর্যবান হও। এটাই এখন আমাদের ভারতবর্ষে দরকার—এই
জন্যেই তোমার ভারতে জন্ম।
‘তুমি তোমার জন্যে নও, সকলের জন্যে। এতেই
তোমার জীবনের সার্থকতা’। মনে রাখতে হবে এই কঠিন আদর্শ তরুণরাই মেনে নিতে পারে,
বৃদ্ধ বা স্বার্থপররা নয়। স্বামীজীর এই আদর্শের আহ্বানে সেদিন অসংখ্য তরুণ
দেশসেবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অনেকে প্রাণও দিয়েছেন।
তাই সমস্ত জাতীয় চেতনার উৎস যে স্বামী
বিবেকানন্দ তা আজ সর্বজন স্বীকৃত। এমন দেশ বরন্যে নেতা কম আছেন যিনি দেশসেবার
প্রেরণা স্বামীজীর কাছ থেকে পান নি। মহাত্মা গান্ধী, শ্রী অরবিন্দ, নেতাজী—এঁরা
প্রত্যেকেই স্বামীজীর কাছে তাঁদের ঋণের কথা মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করেছেন। তার
প্রভাব এখনও কাজ করে চলেছে। ত্যাগ ও সেবাকে স্বামীজী জাতীয় আদর্শ বলে চিহ্নিত
করেছেন। নেতা হতে গেলে ‘শির-দার’ হতে হবে, অর্থাৎ মাথা কেটে দিতে হবে। ত্যাগী না
হলে নেতা হওয়া যায়না। শ্রেষ্ঠ সেবকই শ্রেষ্ঠ নেতা বা নেত্রী। স্বামীজী ও ভগনী নিবেদিতা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাই বক্তব্য দীর্ঘ
না করে বলে যেতে চাই এখনো স্বামীজীর স্বপ্ন সফল হয়নি ভারতবর্ষে। তাই রবীন্দ্রনাথের
কথা দিয়ে বলি-
মার অভিষেকে এসো এসো
ত্বরা
মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা
সবার-পরশে- পবিত্র করা
তীর্থনীরে
আজি ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে। তাই বেদ যজ্ঞের
মাধ্যমেই স্বামীজীর স্বপ্ন সফল করার আহ্বান জানাই সর্বশ্রেণীর ভারতবাসীকে। একজন
মহামানব স্বপ্ন দেখিয়ে যান দেশবাশীকে কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করতে হয় তাঁর রেখে
যাওয়া বংশধরদের। আমরা যেন ভুলে না যায় আমরা সেই মহানদের বংশধর যাঁদের রক্তে
প্রবাহিত হতো সদায় দেশপ্রেমের স্রোত সবার মঙ্গলের জন্যে। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ
শান্তিঃ।