বেদ যজ্ঞ সম্মেলনঃ—০১/ ০৫/ ২০১৬ আজকের আলোচ্য বিষয়ঃ-- মে দিবস উপলক্ষে সবায় সত্যকে জানুক-- কর্মই জীবের ধর্ম আর ধর্মই হচ্ছে জীবের জীবন। [আজকের এই শুভ দিনে বেদ যজ্ঞ উপলক্ষে বিশ্বমানব শিক্ষায় (নাটিকা) কর্মই ধর্ম ]
আজিজঃ আমি তো ভূতের মতো সংসারে খেটে চলেছি। কি পেলাম
সংসার থেকে? শুধু লাঞ্ছনা-বঞ্চনা-আর-অপমান।
মাঃ তুমি সংসারের বড় ছেলে। তোমাকে তো সব সহ্য
করতে হবেই –বাবা। ধৈর্য ধর—কোন ব্যাপারে জ্ঞানীদের দুঃখ বা শোক করতে হয় না। সুখ- দুঃখ –অভাব- অভিযোগ
এগুলি অনিত্য—এগুলি আসে আবার চলে যায়।
আজিজঃ মা- আর কত ধৈর্য ধরতে বলছো—আমিও তো রক্ত
মাংসের মানুষ।
মাঃ তুমি রক্ত মাংসের মানুষ হলেও—তোমার বুদ্ধি
স্থির। তুমি-ই নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে স্থির রেখে এই সংসারের সবাইকে বাঁচার পথ
দেখিয়েছ। তাই এখন স্বধর্ম পালন করায় তোমার কর্তব্য। নিজ সুখের জন্য স্বধর্ম ত্যাগ
করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তোমার কাছে ইহবাদী
শরীরটা তো সব নয়। তুমি তো উজ্জ্বল এক আত্মা হয়ে এই সংসারে বিরাজ করছো নিজে দুঃখী
হয়ে সবার দুঃখ হরণ করে সবায়কে আনন্দে দেখার জন্যে।
আজিজঃ স্বধর্ম বলতে কি বুঝায়--- আমি কি তাহলে
পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছি?
মাঃ তুমি পথভ্রষ্ট হওনি – এখনো কিন্তু হতে চলেছিলে
কোন এক শয়তানের পাল্লায় পড়ে। স্বধর্ম বলতে বুঝায় নিজের কর্তব্য কর্ম সঠিক ভাবে
পালন করা। কোন লোভ বশতঃ বা মজুরী বা নাম সুনাম পাবার আশায় কোন কর্ম করা উচিত নয়।
কর্মকে কর্ম ভেবেই যারা কর্ম করে তারা-ই তো জীবনে
সফল হয়।
আজিজঃ মা, আমি তো নিজের স্বার্থের কথা ভেবে
সংসারে কোন কাজ করি না। যা করি সংসারের সকলের মঙ্গলের জন্যে। কিন্তু ভাইদের ও
তাদের বৌদের ব্যবহারে আমি খুব আঘাত পেয়েছি। তারা তোমার সামনে আমাকে কিভাবে অপমান করলে—তা তো তুমি নিজের চোখে
দেখলে-- ?
মাঃ মান—অপমান, সুখ- দুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়- পরাজয়
এসব তুচ্ছ জ্ঞান করে তোমার কর্তব্য কর্ম করে যাও। একদিন না একদিন তারা নিজেদের ভুল
বুঝতে পেরে তোমাকে সর্ব উচ্চ আসনে বসাবে—দেখে নিও।
আজিজঃ আমার সর্ব উচ্চ আসন প্রয়োজন নেই, মা।
কেবল তোমার আদর টুকু-ই আমার কাছে জান্নাতের সুখ।
মাঃ তারা আমার গর্ভজাত সন্তান হলেও তাদের
বুদ্ধি বহুশাখা বিশিষ্ট ও বিচ্ছিন্ন। তারা একমুখী হয়ে স্বধর্ম পালন করতে অক্ষম।
তাদের চিত্ত কামনা দ্বারা কলুষিত। তাই তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না।
ক্ষণস্থায়ী সুখের জন্য বৃহত্তর শান্তি জলাঞ্জলি দিচ্ছে। মমতাশূন্য ও অহংকারশুন্য
হয়ে একমুখী হয়ে তুমি এক লক্ষ্যে কর্ম করে যাও। এই কর্মই তোমার মনকে সদায় সুন্দর রেখে তোমার আত্মাকে আলকিত করে রাখবে ও
অনন্ত আনন্দের সন্ধান প্রতিনিয়ত দিয়ে তোমাকে নূতন সূর্যের আলোতে উদ্ভাসিত করে
তুলতে থাকবে।
আজিজঃ মা, আমি তো তোমাকে ছাড়া কাউকে চিনি
না। তুমি-ই আমার একমাত্র উপাস্যা আল্লা বা
দেবী। তোমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য-ই আমার কর্ম- আমার ধর্ম- আমার ত্যাগ- আমার সেবা ও
আমার জ্ঞান।
মাঃ বা ছেলে বাঃ; আমার জন্য সব কর্ম—তাহলে আমি
যখন থাকবো না তখন কার জন্যে কর্ম করবে?
আজিজঃ মা, তুমি থাকবে না, তা হতে পারে না—আমি
থাকবো না তাও হতে পারে না। তুমি আগেও ছিলে, পরেও থাকবে। মা আর মাটি এক। যতদিন না
কিয়ামত হয় আমরা সবায় এখানে থাকবো। মহাপ্রলয় কালে স্রষ্টা যখন সৃষ্টি গুটিয়ে নিবেন—তখন
আমরা সবায় এক হয়ে তাঁর কাছে ফিরে যাবো। ততদিন পর্যন্ত আমাদের যাওয়া আসা কাজ- কর্ম
কিছুই বন্ধ হবেনা।
মাঃ ঠিক বলেছ—যতদিন প্রকৃতি থাকবে, ততদিন
আমাদের কর্ম থাকবে। দেহ মাটিতে মিশে যাবে—আবার দেহ ফুটে উঠবে—এই কর্ম জগতের লীলা
চলতেই থাকবে।
আজিজঃ মা, কর্মকে তো ত্যাগ করা যায় না।
কর্মটা-ই তো জীবের ধর্ম। গাছপালা—পশু-
পাখী- আকাশ- বাতাস সকলেই স্ব- স্ব ধর্ম অনুযায়ী কর্ম করে চলেছে। এই কর্মের বন্ধন
থেকে মুক্ত হবার উপায় কি তোমার জানা আছে?
মাঃ কর্ম থেকে অব্যাহতির পথ কারও নেই। কিন্তু
কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মুক্ত পুরুষ বা মুক্ত সত্তা হবার উপায় রয়েছে। তূমি
নিজে কর্তা না হয়ে তোমার অন্তরের পবিত্র জ্ঞানসত্তাকে কর্তা ভাবতে শিখে সমস্ত কর্ম
কর কেবল তাঁর উদ্দ্যেশে তাহলেই কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি পাবে। নিজেকে তাঁর
ভৃত্যবৎ ভেবে বিকেক বুদ্ধি সহকারে সমস্ত কর্ম তাঁকে সমর্পণ করে কামনাশূন্য ও
মমতাশূন্য হয়ে দুঃখ –শোক-তাপ ত্যাগ করে কর্ম করতে শিখো—অচিরেই শান্তি পাবে।
আজিজঃ মা, সময় সময় মন খুব চঞ্চল হয়ে উঠে। মান-
সম্মান- যশ- লাভ- লোকসানের হিসাব বুদ্ধিকে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যায়। তখন অস্থির
হয়ে উঠি।
মাঃ বিশাসী, শ্রদ্ধাবান- ভক্তদের কখনো বিনাশ হয়
না। তুমি তোমার মায়ের প্রতি যে বিশ্বাস, শ্রদ্ধা- ভক্তি অচল রেখেছো তাতেই তোমার
কর্মফল ভোগ করতে হবেনা। তুমি আমার উদ্দ্যেশেই সমস্ত কর্ম অনুষ্ঠান কর- তাতেই তোমার
মুক্তি অনিবার্য। কারণ তোমার অন্তরে জ্ঞান সুদৃঢ় হয়েছে যে মা আর মাটি এক। যত্র জীব
তত্র শিব মানে যেখানে মাটি সেখানেই জীব আর সেখানেই স্রষ্টা।
আজিজঃ মা, আমি তো লেখা- পড়া কিছু শিখেনি। সারা
জীবন চাষ –বাস করে কাটালাম। আমি কিভাবে জ্ঞান লাভ করতে পারি?
মাঃ তোমার পুঁথিগত শিক্ষা বা বিদ্যা নাই- এটা
সত্য কিন্তু তোমার জ্ঞান নেই এটা তো বলা যাবেনা।তোমার অন্তরে যে জ্ঞানের বাতি
জ্বলছে সেই তো তোমাকে জ্ঞানের পথে নিয়ে চলেছে।
আজিজঃ আমার কোন ডিগ্রী নেই—আমি অশিক্ষিত—আমি
অজ্ঞ- আমি মূর্খ একটু আগেই আমার ভাই ও ভাইদের বউরা বলল তা তো শুনতে পেলে—তার পরেও
আমাকে তুমি তাদের থেকে জ্ঞানী বলছো?
মাঃ
কাম- ক্রোধ- লোভ-মোহ মানুষের নিত্য সঙ্গী ও শত্রু। এই কাম- ক্রোধ দ্বারা
মানুষের জ্ঞান ঢাকা থাকে। এই কাম- ক্রোধ- লোভ- মোহকে যে জয় বা দমন করতে পারে সেই তো জ্ঞানী হয়ে উঠে। তোমার শান্ত- সৎ- সত্য ও সুন্দর হৃদয়ের
রূপ তোমাকে জ্ঞানী করে তুলাছে। তোমার মতো পবিত্র মনের মানুষ কজন আছে?
আজিজঃ মা, আমি সাদা-সিদে মানুষ। সহজ-সরল ভাবে
কথা বলি। সহজ- সরল ভাবে জীবন যাপন করি। সামান্য খাবার পেলে-ই আনন্দে আত্মহারা হয়ে
উঠি। সকলে গালা-গালি দেয় তবুও হাসি মুখে সকলের সাথে কথা বলি। আমি জানি আমার ডিগ্রি নাই তাই কোন কাজে আমার অহংকার করা চলেনা। আমার
মা- জননীই আমার ডিগ্রি ও অহংকার।
মাঃ না- বাবা- ডিগ্রী নাই বলে দুঃখ বা অনশোচনা করনা। তোমার অনেক ডিগ্রি আছে—যা
অন্য কারও নেই। ডিগ্রি মানে তো গুনের স্বীকৃতি। কর্মের ও যোগ্যতার স্বীকৃতি।
আজিজঃ মা, সকলে বলে
ইহলোকে জ্ঞানের ন্যায় পবিত্র আর কিছু নাই। কিন্তু এই জ্ঞান তো আমার নাই।
মাঃ কে বললো—তোমার অন্তরে সেই জ্ঞান নেই? তুমি
জন্মসিদ্ধ সেই জ্ঞানী পুরুষ। তাই তো তুমি সর্ব অবস্থায় বুদ্ধি স্থির রেখে শত- দুঃখ
কষ্টেও কর্মে নিষ্ঠা রেখে কর্ম করে চলেছো। কর্মে যারা স্থির তারাই তো জ্ঞান লাভ
স্বাভাবিক নিয়মে করে।
আজিজঃ মা, আমি কোন
অন্যায় বা পাপ যদি করে থাকি ক্ষমা করে দিও। তুমি আমার জ্ঞান, ভক্তি- বিদ্যা-
শক্তি। তুমি-ই আমাকে সবকিছু থেকে রক্ষা করিও। আমাকে ছেড়ে কখনও যেও না।
মাঃ পাগল ছেলে—আমি
তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাব? যারা অজ্ঞ, শ্রদ্ধাহীন, অবিশ্বাসী তারা আমাকে ছেড়ে গেলেও
আমি তাদেরকে ছেড়ে যাই না। তুমি তো আমার শ্রদ্ধাবান বিশ্বাসী একনিষ্ঠ কর্মবীর
সন্তান।
আজিজঃ মা, মন, বুদ্ধি,
অহংকার, বিবেক এই চারটি স্থির হয় কিভাবে? এরা তো সর্বদায় বিপরীত মুখী হয়ে ধাবিত
হতে চায়।
মাঃ কামনাশুন্য হয়ে
কর্তব্য কর্ম ভেবে কেবল সৎ কর্ম করে যাও। মজুরী
পাবার আশায় বা কর্মফলের আশায় কোন কর্ম করবেনা—দেখবে তাহলে সেই কর্মে ক্লান্তি বা
অবসাদ আসবে না। সর্বদায় বলবে—হে আমার অন্তরের দেবতা—আমার বিশ্বাস বাড়িয়ে দাও—আমাকে
সর্বদায় একমুখী করে রাখো—আমার নামাজ – আমার রোজা—আমার যাকাত—আমার কর্ম – আমার ধর্ম
–আমার সমাজ—আমার শিক্ষা—দীক্ষা-জ্ঞান- শক্তি- ভক্তি সবকিছুই তোমার চরণে নিবেদিত।
তুমি ছাড়া আমার দ্বিতীয় কোন উপাস্য নেই। আমাকে যেন পার্থিব জগতের কোন সম্পদ স্পর্শ
করতে না পারে ও এই জগতের চাকচিক্য দেখে আমি যেন তোমাকে ভুলে না যাই। আমি যেন
মুশরিক বা মোহিত সত্তা না হয়ে পড়ি
তোমার কর্মভূমি ও জ্ঞানপীঠে এসে।
আজিজঃ মা, সত্যি তুমি আমার একমাত্র উপাস্যা
দেবী। আমি সর্বদায় এই প্রার্থনায় করি। বলি—হে আল্লা তুমি পৃথিবীর জ্যোতি হয়ে আমার
এই পৃথিবী স্বরূপ দেহের অন্তরে রয়েছ—যেরূপ সূর্য- চন্দ্র- আকাশ- বাতাস- সর্বত্র রয়েছ জ্যোতি হয়ে। আমার মায়ের অন্তরেও
তুমি জ্যোতি হয়ে রয়েছ – তোমার-ই জ্যোতিতে এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রকাশ। তাই তো
তোমার সেই জ্যোতির উপাসনা করি—যা চিরঞ্জীব। মা-গো আমার উপাসনা মানে তাঁর উদ্দ্যেশে
কর্ম করে যাওয়া।
মাঃ কর্মই তো জীবের ধর্ম। তাই তোমার পথ-ই হচ্ছে
জ্ঞানীদের পথ। চলো এবার খেতে চলো—আর রাগ নয়। আজ মে দিবস সারা বিশ্বে এই দিনটি পালিত হচ্ছে কর্ম দিবস উপলক্ষে কিন্তু
দুঃখের বিষয় মানুষ আজও জানতে পারলো না এই কর্মভুমি ও জ্ঞানপীঠে কি তাদের কর্ম আর
কি তাদের ধর্ম?
আজিজঃ মা – চলো আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই একটু
কিছু খাবার দাও জমিতে যেতে হবে – আমাকে আমার সবুজ ঘেরা শষ্য শ্যামল মাঠ ডাকছে। এই
মাঠই হচ্ছে আমার জীবন- আমার ধর্ম – আমার কর্ম – আমার সময় ও মে দিবস।
জয় বিশ্বমানব শিক্ষার জয়